নতুন ঠিকানা
নাসির ওয়াদেন
অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে অবশেষে জোগাড় হল ঠিকানাটা। যাব, যাচ্ছি করে কেটে গেল কয়েকটা মাস। কালো আকাশের বুকে ছোট একটি তারার মত এক টুকরো আলোর শিখা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালো মন্টু ভাই, সম্পর্কে ওরা মাসতুতো পিসতুতো দাদা ভাই। মুন্টু ‘মামাতো’ ভাই বলতেই অজ্ঞান।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে বাবা রসুল মিয়ার হাত ধরে গা ছেড়ে ছিল খলিল মিয়া ও ওর পরিবার। বকুল তখন নিতান্তই খুব ছোট। তখন সারা দেশ একটা অস্থির সময় কাঁধে নিয়ে হাঁটছে। কিছুদিন আগেই ” ভাত দাও, ফ্যান দাও” বলে গাঁয়ের গরীব লোকগুলো দলে দলে গ্রাম ছেড়ে বাবুদের শহরে পা বাড়িয়েছে । চারিদিকে অনাবৃষ্টি, খাবারের তীব্র অভাব। গাঁয়ের লোকগুলো ঠিকমত দুবেলা খেতে পায় না, মাঠে-ঘাটে অনেকেই কচু এঁটে তুলে আনে, শাক-সবুজ পুড়িয়ে খেয়ে দিন গুজরান করে। কেউ কেউ একবেলাও আহার পায় না, ওদের ছেলেদের জল খেয়েই দিন কাটাতে হয়।
অভাবী মানুষের ভিড়ে কলকাতা ছয়লাপ, ভর্তি। উপচে পড়ছে শহর আগন্তুক বাহিনীর গমনে । বিহার থেকে পেটের টানে অনেক সম্বলহীন মানুষ কলকাতায় এসে হাতেটানা রিক্সা চালিয়ে জীবন নির্বাহ করছে। কেউ কেউ কাজের সন্ধানে এসে অল্প মজুরিতে চটকলে কাজ নিয়েছে। আশ্রয় না থাকায় কেউ গাছতলায়, আবার কেউ কেউ বসতি এলাকায় আশ্রয়ের চেষ্টা করছে।
রসুল মিয়ার আদি বাড়ি বিহারের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। খাবারের সন্ধানে শেষ সম্বলটুকু মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছায় বাংলার উপকণ্ঠে এক দেহাতি পল্লীগ্রামে। সেখানেই এসে পেতেছে সংসার। তার শ্বশুরমশাইয়ের চালের ব্যবসা আর কিছু জমিজমা ছিল। মহাজনের কাছে টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে তাঁর জমি জায়গা সবকিছু বন্ধকে আটকে পড়ে। মহাজনের সেই টাকা শোধ করতে না পেরে জমি জায়গা বিক্রি হয়ে যায়। জীবনের সঞ্চিত সবকিছু মহাজনের ঋণ শোধ করতে গিয়ে সব চলে যায়। এদিকে চালের ব্যবসাতেও মন্দা নেমে আসে । কোনরকমে টেনেটুনে,খু্ড়িয়ে,খুঁচিয়ে সংসারটা চলছে। সেসময়ে বহির্রাজ্যে চাল,খাদ্যশস্য চলে না যেতে পারে, তার জন্য সীমান্তে বর্ডার বসানো হয়েছে। একদিন রসুল মিয়ার শেষ সম্বল বলতে, তার লাল ঘোড়াটার পিঠে চড়ানো চালসহ ঘোড়া লুট করে নিয়ে যায় লাল পুলিশ। কাউকে কিছু না বলে হুট করে একদিন রসুল মিয়া নিখোঁজ হয়ে যায় গ্রাম থেকে। অনেক সন্ধান করেও তাদের হদিস পাওয়া যায়নি।
রসুল মিয়ার বাড়িখানা চারিদিকে মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, ভিতরে ছোট বড় নানা জাতের পেয়ারা আর পেঁপের গাছ বসানো। ছেলেবেলায় সেই বাড়িতে খেলতে যেত বকুল, সঙ্গে একদল কচিকাঁচাদের দঙ্গল। রসুলমিয়া ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি, বাংলায় কথা বলতো, — ও লেড়কা, আমরুট খায়েগা ?
অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত বকুল। ভাষা বুঝতে না পেরে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত তাঁর দিকে।
— আও, আও না, আদর মে। লাজ ক্যান করছো লেড়কা।
কিছুক্ষণ পর, আবার বলতো– সমঝে গা, সমঝোতা নেহি। তুম হামার বাত নেহি বুঝতে পারছো। ও পেয়ারা আছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমগো দেশ মে এহি বোলতা, তুমহারা এসব বাত কেইসে সামঝেগা বোলো? ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়, তুম পেয়ারা তো লো একঠো।
বকুল তার ভাষা শুনে অবাক হয়ে যেত, হাত বাড়িয়ে পেয়ারাখানা নিয়েই দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেত বাড়ির দিকে ।
রসুলমিয়া নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন পরে খলিলমিয়াও সপরিবারে বাক্সপাটরা মাথায় নিয়ে চলে যায়। তাদের চলে যাওয়া আজ অনেকদিন,তা কয়েক যুগ হবে । ওরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে যায় ,বহুদূরে, চোখের বাহিরে ,,,
অনেকদিন পরে বকুল বড় হয়ে জেনেছে যে ওরা শ্যামনগরে থাকে। সেখানে একটা চটকলের কারখানাতে শ্রমিকের কাজ করে। গ্রাম ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ সেদিন নতুন আশ্রয় এর সন্ধানে কলকাতায় চলে যায়। মানুষ চায় বাঁচতে, চায় দু’মুঠো অন্ন আর একটুকরো মুক্ত হাওয়ায় প্রাণ খুলে বেঁচে থাকতে। আরও চায় খোলা আকাশের নিচে প্রাণ ভরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে। এভাবেই বেঁচে থাকতে চেয়েছে গ্রাম ছাড়া গরীব হতশ্রী মানুষগুলো।
মাটির পাঁচিল ঘেরা, তালা লাগানো বাড়িটার ভিতরে অবাধে ঢুকে যাওয়ার সুযোগ হারিয়ে গেল ছেলেদের। তবু কেউ কেউ পাঁচিল টপকে ভিতরে যায়, পেয়ারা গাছে চড়ে কাঁচা পাকা পেয়ারাগুলো পাড়ে। লাল লাল পেঁপেফল গাছে পেকে থাকে, পাখিরা ঠোঁট দিয়ে সেই পাকা পেঁপে খেয়ে যায়। কাঠবিড়ালি, শালিক,চড়ুইয়ের দল এর ডালে ডালে খেলা করে বেড়ায়। বাইরে থেকে দেখলে বাড়িখানাকে যমপুরি বলে মনে হয় ছেলেদের।
২
কোরবানির ঈদে প্রতিবছর এখন ওরা এই গাঁয়ে আসে। ওই সময়ে তারা কিছু পয়সা জোগাড় করে, সেই টাকা দিয়ে কোরবানির পশু কিনে কোরবানি দেয়। যখন ওরা গাঁয়ে আসে তখন বকুলরা খুব খুশি হয়। বাড়িতে গিয়ে কত গল্প করে। চটকলে কি কি কাজ হয়, কখন যেতে হয়, কখন ছুটি হয়, কত পয়সা দেয়, এরকম হাজার প্রশ্ন। বকুল মনে মনে ভাবে, বড় হয়ে সেও ওদের সাথে গিয়ে একটা চটকলের কাজে লেগে যাবে। রসুল মিয়া নিখোঁজ হওয়ার পর সংসারের হাল ধরে খলিল মিয়া। বউ ছেলে নিয়ে তার বিশাল সংসার। ছেলের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলে। সংসারে টান পড়ে মাসের শেষের দিকে ধারদেনাও করতে হয়। ঋণ শোধ করতে গিয়ে আর পেটের খাবার জোগাড়ের জন্যে তাদের বসত বাড়িখানাও বিক্রি হয়ে গেল একদিন।
বকুলের মা খলিল মিয়াকে খুব ভালোবাসতো, সেও তাকে ” চাচী জান ” বলে সম্বোধন করতো। বকুলের মা ছিলেন খুব ধর্মভীরু, নরম ও দয়ালু প্রকৃতির মানুষ। নিজে না খেয়ে অতিথিদের খাওয়াতে কার্পণ্য ছিল না তার। একবার খলিল মিয়া গায়ে আসে। এসে বলে, চাচি জান ! আমি তো ভাইয়ের বিয়েতে আসতে পারিনি। আমি এই সামান্য শাড়িখানা এনেছি, রেখে দাও। আমার বড় শখ ছিল ভাইয়ের বিয়েতে আসব, ভাইয়ের বৌ-কে একখানা শাড়ি দিমু।
— না না এসব কি কথা বলছ খলিল। তোমরা কত কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছো শুনেছি। তারপর এত সুন্দর দামি তাঁতের শাড়ি কাপড় কেনার কোন মানে হয় ?
— ও কথা বুলবেন না চাচি ,টাকা দিয়ে কি সবকিছু কেনা যায় ? আমার তো বিবেক বলে একটা চিজ আছে; বল?
বিবেকের কথা শুনে বকুলের মা হাসত, আর বলত, খুব জি দরদ দেখাচ্ছিস; তা বলি যেদিন না খেতে পেয়েই গা ছাড়লি, সেদিন তো কেউ তোদের আটকায়নি, আমিও না। আমার আর কতটুকু সাদ্দি বল ?
— এটা কি একদিনের কথা চাচি! যার কপালে দুখ লেখা আছে, তাকে তো দুখ পোহাতেই হবে, যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফল ভোগ করবে। মা বলতো শুধু শুধু কপাল চাপড়ালে হবে ? হাত দুখানাকে কাজে লাগাতে হবে। এই হাত দুখানাতেই মানুষের কপাল ফিরতে পারে।
বকুলের মায়ের কথা শুনে খুব ভালো লাগতো, তার মা স্বল্পশিক্ষিতা, ভারী মিষ্টি, বিহারী মেয়ে কবিরাজ, ডাক্তারের আদরের তৃতীয় সন্তান কন্যা। হিন্দি, বাংলা, উর্দু ভাষায় কথা বলতে পারতো। সে সময়ে মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে সমাজে রি রি পড়ে যেত।
তার মাকে রোজ সাঁঝ আর ভোরবেলায় নামাজ সেরে কোরআন তেলাওয়াত করতে দেখেছি, ‘ হুলিয়া নামা’ সুর করে পড়ত। হুলিয়া নামা পড়ার সময় জোর করে তাকে পাশে বসিয়ে রাখত, বলতো– জানিস খোকা, যারা রোজ কেয়ামতের দিনে নবীজিকে চিনতে পারবে, তারাই বেহেস্তে যেতে পারবে। বকুল অবাক হয়ে বসে মুখের বর্ণনা শুনত। তার মা সুন্দর করে দোযখ বেহেস্তের বর্ণনা দিত আর বলত, আমাদের ধর্মে নবীজির কোন ছবি রাখা চলবে না, নিষিদ্ধ। তাই তাঁর চরিত্র ও রূপের বর্ণনা দিয়ে এই হুলিয়া নামা লেখা হয়েছে। তোরা বড় হয়ে ভালো করে পড়বি, সবকিছু ভালো করে জানতে পারবি।
মায়েদের সরলতা, ধর্ম-ভীরুতার কথা মনে পড়ে। মানুষ কত যে সাদাসিদে হতে পারে, তা না দেখলে বোঝা মুশকিল। আজকাল মানুষের মনের মধ্যে নানা কুটিল চিন্তায় ভর্তি। বকুলের মা চলে যাওয়ার আগে ওসিয়ত করে গেছিল বকুলকে, তুই যদি পারিস একবার খলিলের বৌমাদের দেখে আসিস। হয়ত কিছুটা ঋণ পরিশোধ করা হবে।
তার মা মরে যাওয়া অনেকদিন হল। নানা কর্মসূত্রে থাকার জন্য সময় করতে পারেনি বকুল। তাই খলিলের দেওয়া ঋণ পরিশোধের যাতনা তাকে কুরে কুরে খায়।
ঠিকানাটা জোগাড় হতেই মুন্টু ভাইয়ের সাথে শ্যামনগরে যাওয়ার দিন ঠিক হল। খলিলের সেজে ছেলের বিয়ে। যাওয়া এক রকম ঠিক হলো, এবারে কোন অন্যথা হবে না। যাব যাব করেও কোনদিন যাওয়া হচ্ছিল না। নানান কাজে, কাজের চাপে পড়ে বকুলের আত্মীয়তা করা বন্ধ হয়ে গেছে। আত্মীয় স্বজনরা ভুল বুঝে তাদের বাড়িতেও আসতে চায় না।
একদিন সন্ধ্যায় মুন্টু ভাই এসে বলে, মাস্টার ভাই! এবার কলকাতা চলো। যাব, যাব করে তো তোমার যাওয়া হয়নি। যাওয়ার দিনে হাজার বিপদ এসে দাঁড়ায়। নিশ্চয়ই এবার যাবো। কেউ আটকাতে পারবে না, বলে বকুল।
বিহার তারিখ মুনে আছে তো ? সামনের ফাল্গুন মাসের ২৮, রোববার, দিনটাও খুব ভালো, বল? তোমার স্কুলও কামাই হবে না আর তো। নরম সুরে কথাগুলো বলে মুন্টু।
— হ্যাঁরে ভাই, এবার অনেক কষ্ট করে সব কাজ আগেই সেরে নিয়েছি। পারমিশনটাও করে ফেলেছি। এবারে আটকায় কে?
মুন্টু চলে যায়।
মুন্টু আসে। সেদিন এসে বলে, কিছু শুনেছ মাস্টার ভাই!
অবাক হয়ে বকুল শুধায়– কি হয়েছে মুন্টু ?
মুন্টু বলে– বিয়েটো ভেঙ্গে গেল মাস্টার। বউয়ের বাবা চট কলে কাজ করতে করতে অ্যাক্সিডেন্টে মরে গেছে। দুটো হাতই কেটে গেছিল, পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই মারা যায়।
মনটা খারাপ হয়ে গেল বকুলের। মন কষ্ট ভরে ওঠে। বকুল বলে, তো একবার দেখা করা দরকার। বলে, একদিন তবে চলো মুন্টু, একবার দেখা করে আসা উচিত।
মুন্টু বলে ,তরশু দিন সকালের এক্সপ্রেস ট্রেনটি ধরছি। বলেই চলে যায়।
হঠাৎ সেদিন খলিল মিয়া রাতের গাড়িতে এসে হাজির ।এসেই বকুলের দরজায় টোকা মারে। দরজা খুলে বকুল দেখে খলিল ভাই। বলে, আরে খলিল মিয়া, আসো, আসো, ভিতরে আসো।
— না, মাস্টার ভাই, ভিতরে এখন যাব না। মন্টু ভাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, আজকে ওর বাড়িতেই থাকবো। আমার বড়,,,,
বিপদের গন্ধ পেয়ে চমকে উঠে বকুল। বলে, কি কি হয়েছে ? একটু খুলে বলবে?
আমাদের চটকল বন্ধ হয়ে গেছে ।লকআউট, ঘোষণা করে নোটিশ জারি করেছে। কবে খুলবে জানি না, এই কয়দিন কোথায় থাকবো, কি খাব কিছুই জানি না। বাড়িতেও অনেক লোকজন, সংসার চলবে কি করে !
তাহলে তোমরা কি করবে?
— না খেয়ে যে মরতে হবে। যে জমিটুকু করেছিলাম, এবার সেই জমিটুকুই বেঁচে দেব। ওখানে বাড়িঘর ভাড়া করে আর কতদিন থাকব বল? গাঁয়ে মন্টু ভাই একটা জায়গা দেখেছে; ওটা কিনে আবার নতুন করে বাড়ি বানাবো। এই গাঁয়ে
আবার ফের ফিরে আসব। একটা কথা, কাল
সকালে তোমার এখানে আসছি, চা খাব।আর কিছু কথা আছে,সে গুলো বলব। এই বলে রাখছি। বলেই ওরা দুজনে চলে যায়।
একদিন খাবারের সন্ধানে হাজার হাজার মানুষ গ্রাম ছাড়া হয়েছিল, গেছিল শহরের দিকে। একটু ফ্যানের আশায়,দুটো ভাতের সন্ধানে। আজ আবার পুঁজির দাপটে কাজহারা হাজার হাজার মানুষ, তাদের মাথা গোজার একটুও ঠাঁই নেই। তারা আজও নতুন ঠিকানার সন্ধানে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
—–
নাসির ওয়াদেন
মুরারই: বীরভূম
ফোন –৭৯০৮৩২৭৫৬৯
নাসির ওয়াদেন