লিটিল ম্যাগাজিন রিভিউ
বইমেলা থেকে ফিরে

তৈমুর খান

বইমেলাকে কেন্দ্র করে বেশকিছু লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের দফতরে আসা কয়েকটি লিটিল ম্যাগাজিন এবারের আলোচনায়।

১
এবং আমোদর

দ্বিতীয় সংখ্যা ‘এবং আমোদর’ (জানুয়ারি২০২৩) প্রায় শতাধিক কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও অণুগল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। গৌতম চক্রবর্তী দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘তথাকথিত সার্থক নদী এবং আমোদর’ গদ্যটিতে আমোদরের পরিচয় দিয়েছেন। আমোদর কীভাবে জনজীবনে সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং ভৌগোলিক বিন্যাসকে নিয়ন্ত্রিত করে চলেছে তার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। গুরুদাস দাস ‘ফুরিয়ে যাওয়া নদীর গল্প’ নামক কবিতায় মৃতপ্রায় নদীকে বাঁচানোর উপায় খুঁজেছেন। শাশ্বতী চক্রবর্তীর ‘মাস্টার মশাই’ একটি আদর্শ ছোটগল্প। এছাড়া ‘পারঘাটার গল্পে ওরা তিনজন’ গল্পে তারকনাথ মাঝি সহানুভূতি জাগ্রত করেছেন যা মানবিক চৈতন্যকে নাড়া দেবে। অনেক ভালোলাগা কবিতা এই পত্রিকায় রয়েছে। দুর্গা মণ্ডল, গৌতম মুখোপাধ্যায়, দেবীপদ মুখোপাধ্যায়, শান্তি রায়, সাধন বারিক, হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দরিপা, নিশীথ ষড়ংগী, তরুণ মান্না, স্নেহাংশুবিকাশ দাস, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, বাবলু সরকার প্রমুখ বহু কবি ভালোলাগার তালিকায় উঠে আসবেন। বেশ রুচিপূর্ণ সুন্দর একটি পত্রিকা। যোগাযোগ: সম্পাদক গুরুদাস দাস, সাতবেড়িয়া (কামারপুকুর), জেলা হুগলি- ৭১২৬১২, চলভাষ: ৯৬০৯৭৭১৩৫৭, মূল্য ৩০ টাকা।

২
রেশম ঝাঁপি প্রবন্ধ সংকলন

‘রেশম ঝাঁপি প্রবন্ধ সংকলন’(ডিসেম্বর ২০২২) রীতিমতো চমকে দেয়ার মতো একটি সংকলন। মোট ১৬ টি প্রবন্ধ সূচিপত্র উল্লেখ করা হলেও সূচিপত্রে লেখকের নাম উল্লেখ করা হয়নি। প্রতিটি প্রবন্ধই তথ্যপূর্ণ ইতিহাস ধর্ম-দর্শন-তত্ত্ব ও বাস্তব ভিত্তির উপর চর্চিত বিষয় নিয়েই লেখা হয়েছে। যেমন ‘সবুজপত্র পর্বে রবীন্দ্র ছোটগল্প’ লিখেছেন বিধান সাহা; ‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করে হিন্দু ধর্মকে সর্বজনীন করতে চেয়েছিলেন রামমোহন’ লিখেছেন প্রবীর নন্দী; ‘প্রসঙ্গ: নরবলি দু’চার কথা’ লিখেছেন অনিন্দ্য পাল; ‘ক্ষুদিরাম বসু সমগ্র ভারতের যুবসমাজের আদর্শ হওয়া উচিত’ লিখেছেন বটুকৃষ্ণ হালদার; ‘রবীন্দ্র ঈশ্বরতাত্ত্বিকতা’ লিখেছেন সুমন নস্কর; ‘রাজসিংহ,বাংলা সাহিত্যের সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস’ লিখেছেন পূর্বাশা মণ্ডল; ‘হাইনরিখ শ্লিমান এক রূপকথার আবিষ্কারক’ লিখেছেন অভিষেক অধিকারী; প্রসঙ্গ: ‘রবীন্দ্র মৃত্যুবলয় রবীন্দ্র মৃত্যু’ লিখেছেন কুমারেশ সরদার, ‘কবিগুরু ও মিড ডে মিল’ লিখেছেন তপন তরফদার, ‘ঐতিহাসিক মিশর’ লিখেছেন বীরেন্দ্রনাথ মণ্ডল, ‘দেবগ্রাম দেবলগড়ে পাল-সেন রাজা ও মুঘল আক্রমণ’ লিখেছেন হরেন্দ্রনাথ গোস্বামী; ‘বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের কর্মজীবন ও সাধনা’ লিখেছেন অর্পিতা ঘোষ পালিত ইত্যাদি। প্রতিটি লেখা-ই গবেষণালব্ধ বিষয়। সংকলনটির মুখবন্ধে বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন: ‘তোমার ঝাঁপির একদিনে হয়নি বুনন/ সাহিত্যের ভাণ্ডারে তুমি সরস্বতী সারস্বত সাধনা।’ বইটি হাতে নিলে এ কথার সত্যতা প্রমাণ করা যায়। যোগাযোগ: ব্লুমস প্রকাশন, কুমারেশ সরদার, চাঁদপুর, সোনারপুর, কলকাতা ৭০০১৫০, চলভাষ ৯৮৩০৩৬২৮৫০,
মূল্য ২২০ টাকা।

৩
উত্তরপক্ষ

‘উত্তরপক্ষ’(বইমেলার সংখ্যা ২০২৩) মূলত কবিতা প্রধান একটি সংখ্যা। এই সময়ের প্রায় শতাধিক কবির কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। আছেন বিরূপাক্ষ পণ্ডা, সৌমিত বসু, সুজিত দাস, সুমিতাভ ঘোষাল, হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপ্লব চক্রবর্তী, মলয় চৌধুরী, শুভশ্রী মাইতি, অমিত চক্রবর্তী, অমিত গোলুই, পাপড়ি গুহ নিয়োগী, নরেশ মল্লিক, শুভঙ্কর দাস, মানসী কবিরাজ, উদিত শর্মা, দেবাশিস সাহা, গৌতম চৌধুরী, প্রমুখ বহু কবি। রূপক চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন: “নিঃসঙ্গতা আর আমার পাশাপাশি ঘর।/ দুজনেই মুখোমুখি রাত্রি জ্বেলে বসি,/ নিমফলের মতো বিষাদ তারারা ঝরে।” দেবদাস রজক লিখেছেন: “স্মৃতিরা সূর্য হয়ে ভালবেসে ডাকে তালবনে”। অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী লিখেছেন: “কী ভীষণ শূন্য নিয়ে ইশারাগুলো রোদ্দুরে মেলে দেয় শাড়ি।” ইত্যাদি পঙক্তিগুলি মনের মধ্যে গেঁথে যায়। কবিতা আর জীবন একই সরলরেখায় এসে দাঁড়ায়। যোগাযোগ: সম্পাদক অনিরুদ্ধ সুব্রত, সুতরাং, বাণীপুর-৭৪৩২৩৩, উত্তর ২৪ পরগনা, মূল্য ১০০ টাকা। চলভাষ ৮৪৩৬৩৮৭৩৯১।

৪
ধ্রুবতারা

‘ধ্রুবতারা’(বইমেলা ২০২৩) ১৩ বর্ষের এই সংখ্যাটি তুষারকান্তি সাহার প্রচ্ছদে অসাধারণ হয়ে উঠেছে। পঞ্চাশাধিক কবির বাছাই করা কবিতায় এবং চারটি অণুগল্পে সংখ্যাটির পূর্ণতা। তাপস রায় লিখেছেন: “ভোটার ফেরাতে চেয়ে বংশীবাদক জড়িবুটি এনেছে এখন। উবু হয়ে আগুন পোহাবে”। তাপস ওঝা লিখেছেন: “নুন,তেল,বেসনের ব্যবহৃত শব্দগুলি/ মাঝরাতে আমাকেই উন্মাদ করে।” মালবিকা হাজরা লিখেছেন: “দুপুরের ডাকবাক্সের মতো পাহাড়ের বাঁক। একটি বিশ্বস্ত পংক্তির দিকে হেঁটে যায় নির্জন চোখ।” একান্ত অভিনিবেশে কবিতাগুলির এই উচ্চারণ মনের মধ্যে নানা অভিঘাত তোলে। আছেন ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য, সন্তর্পণ ভৌমিক, নীলম সামন্ত, সায়ন্তনী ভট্টাচার্য, অরুণ পাঠক, দীপঙ্কর সরকার, স্নেহাংশুবিকাশ দাস, শীলা বিশ্বাস, সায়ন্তনী হোড়, অভিজিৎ দাশগুপ্ত, রাজীব পাল,অনিমেষ গুপ্ত,অনুপ মণ্ডল,সুজল সাহা, বাসুদেব সেন, তন্দ্রা ভট্টাচার্য প্রমুখ বহু কবি। অণুগল্প লিখেছেন সুদীপ ঘোষাল, সৌমিত্র চৌধুরী, শোভন মণ্ডল, চন্দন বিশ্বাস। যোগাযোগ: সম্পাদক সঞ্জয় ঋষি,বাণীপুর-৭৪৩২৩৩, উত্তর ২৪ পরগনা, মূল্য ১০০ টাকা। চলভাষ ৯৫৬৪৩২১৩১১।

৫
অঙ্কুরীশা

‘অঙ্কুরীশা’(বইমেলা ২০২৩) সংখ্যাটি স্বাধীনতা ৭৫ এর বিষয় ভাবনাকে কেন্দ্র করেই প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে: “বহু বিপ্লবীর রক্তে ধোয়া এই স্বাধীনতাকে স্মরণ না করলে, তাকে শ্রদ্ধা না জানালে ঋণী হয়ে থাকব আমরা। এ আমাদের আজন্মের ঋণ।” এই ঋণের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই নানা ভাবনা ও স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেছেন লেখকবৃন্দ। অগ্নিযুগের যাত্রাগান নিয়ে লিখেছেন সন্দীপন বিশ্বাস। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমরা কেমন আছি তা জানিয়েছেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। আমাদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎকে নিয়ে বেঁচে থাকার কথা লিখেছেন বিকাশ গায়েন। স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করিয়েছেন বিশ্বেশ্বর রায়। স্বাধীনতার দেশভাগের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করিয়েছেন এক জীবনালেখ্যে ভবেশ বসু। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে অন্তরায়গুলি উল্লেখ করেছেন অশোক রায়। স্বাধীনতা ও আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করেছেন দীনেশ সরকার। স্বাধীনতার উপলব্ধি কতখানি গভীর হতে পারে সেই বোধ বিশ্লেষণ করেছেন সন্দীপ দত্ত। স্বাধীনতা বিষয়ে কবিতা লিখেছেন জয় গোস্বামীও। তিনি উল্লেখ করেছেন “আমরা সম্মান রাখব ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার/ ওই দ্যাখো সর্বধর্ম সমন্বয়ে ভোর আসছে, ভোর” এই ভোরের অপেক্ষাব এখনো আমাদের। জ্যোতির্ময় দাশ, বীথি চট্টোপাধ্যায়, দীপ মুখোপাধ্যায়, সমাজ বসু, শ্যামল জানা প্রমুখ বহু কবির কবিতা। যোগাযোগ: সম্পাদক বিমল মণ্ডল, মহিষাদল, পূর্ব মেদিনীপুর- ৭২১৪৩২, মূল্য ১৫০ টাকা। চলভাষ ৯৪৩৪৮০২২৬৭।

৬
বালুতট

দ্বিতীয় বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ‘বালুতট’(জানুয়ারি২০২৩) সংখ্যাটির প্রচ্ছদে বিশ্বকাপ খেলোয়াড়দের ছবি থাকায় বেশ অন্যরকম লাগছে। ভেতরের পৃষ্ঠায় কবিতাগুলির পংক্তি আড়াআড়িভাবে না সাজালেই ভালো হত। লাইনগুলির পারস্পরিক সমতা রেখে ক্রমান্বয়ে রাখাই জরুরি ছিল। এই সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন: বিনয় লাহা, অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়, সুদীপ পাঠক, প্রদীপকুমার দে, দীপ্তরূপা মল্লিকদাশগুপ্ত, প্রদীপকুমার দাস, দীপান্বিতা হক।, তন্দ্রা ভট্টাচার্য, অমিতাভ সিনহা, সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়, সাইফুল ইসলাম প্রমুখ বহু কবি। অণুগল্প লিখেছেন রানী সেন, নীলাঞ্জনা হাজরা, বিদ্যুৎ মিশ্র, কাজী সামসুল আলম, রবীন বসু, বিজয়া দেব, অমৃতা ঘোষ, অনিতা আচার্য, ঈপ্সিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, মতিউর রহমান প্রমুখ বহু লেখক। প্রবন্ধ লিখেছেন বিনয় লাহাকে নিয়ে প্রীতম পাল। বেশ চিমছাম পত্রিকাটিতে আরেকটু নজর দিলে ভালো হয়। যোগাযোগ: সম্পাদক সৌমিত্র মুখার্জি, দক্ষিণ চকভবানি, বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর-৭৩৩১০১, মূল্য ৫০ টাকা। চলভাষ-৭০০১০৪৬৪৭২।
