এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)
🐦
পর্ব-২০
এজীবনে শুধুই আঘাত
🍁
ব্যর্থতার বীণা বাজানোর নামই কবিতাজীবনকে স্বীকার করে নেওয়া বলেই আমার মনে হয়েছে। যত কবিতাই বেরিয়ে এসেছে সবই কোনো অসহায়তা আর অসহ্য আর দুঃখ থেকে। কবিতার ভাষা তো দুঃখের ভাষাই, কান্নার ভাষাই। হয়তো প্রতিবাদ আছে, হয়তো উত্তরণ আছে, কিন্তু তা বড় নিরীহ, মননের কাছে এক সান্ত্বনার মতো। রাষ্ট্রশক্তির কাছে, দুর্নীতির কাছে, অমানবিকতার কাছে কবিতার প্রতিবাদের কি কোনো মূল্য আছে?
আপাতত ভাবে তা নেই অবশ্যই, কিন্তু কবি কী নিয়েই বা থাকবেন? নিজের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যম তো কবিতাই তা সাহিত্যই । দুঃখ তো প্রতিটি মানুষের জীবনেই বিরাজ করছে। কবি-সাহিত্যিকরা তাকে বেশি করেই ভোগ করে থাকেন। আবার এই দুঃখ কখনো কখনো উপভোগ্যও হয়ে ওঠে।তরুণ আমেরিকান কথাশিল্পী জ্যান্ডি নেলসন(১৯৬৫)-এর ২০১০ সালে লেখা উপন্যাস ‘দ্য স্কাই ইজ এভরিহোয়্যার’ যা ২০২২ সালে জোসেফাইন ডেকার দ্বারা পরিচালিত সিনেমায় রূপ পেয়েছে। সেই গ্রন্থে দুঃখের প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন লেখিকা:
“grief is a house
where the chairs
have forgotten how to hold us
the mirrors how to reflect us
the walls how to contain us
grief is a house that disappears
each time someone knocks at the door
or rings the bell
a house that blows into the air
at the slightest gust
that buries itself deep in the ground
while everyone is sleeping
grief is a house where no one can protect you
where the younger sister
will grow older than the older one
where the doors
no longer let you in
or out”
(Jandy Nelson, The Sky Is Everywhere)
অর্থাৎ “দুঃখ এমন একটি ঘর
যেখানে চেয়ারগুলি
ভুলে গেছে কীভাবে আমাদের
আয়না ধরে রাখতে হয় কীভাবে দেওয়ালে আমাদের প্রতিবিম্বিত করা যায় কীভাবে আমাদের দুঃখকে
ধারণ করা যায় এমন একটি ঘর যা প্রত্যেকবার দরজায় ধাক্কা দিলে বা ঘণ্টা বাজালে এমন একটি ঘর অদৃশ্য হয়ে যায় যা বাতাসে উড়ে যায় সামান্য দমকা হাওয়া মাটির গভীরে নিজেকে পুঁতে দেয় যখন সবাই শোকে ঘুমিয়ে থাকে এমন একটি ঘর যেখানে কেউ আপনাকে রক্ষা করতে পারে না যেখানে ছোট বোনটি বরের চেয়ে বড় হবে যেখানে দরজা আপনাকে আর ভেতরে বা বাইরে যেতে দেয় না”
দুঃখের কোনো পূর্ণচ্ছেদ নেই। তা প্রবহমান হয়ে চলে। দুঃখের কোনো সামঞ্জস্য নেই, সামাজিকতা নেই, পারিপাট্য রূপ নেই;দুঃখ এলোমেলো, বিবশ বিষণ্ন বিব্রত অন্ধ ও বিবেক বর্জিত। তাই তাকে কি শিল্প বলা যায়?
অবশ্যই তা দুঃখের শিল্প, সেখানে হাহাকার থাকে, দীর্ঘশ্বাস থাকে, ছন্দোহীনতা থাকে, অমসৃণতা থাকে, প্রসঙ্গচ্যুতি থাকে, বেমানানের আয়োজন থাকে।অবচেতন প্রভাব ফেলতে পারে। স্বয়ংক্রিয়তায় তার গতিও সঞ্চারিত হতে পারে। মোটকথা শিল্প ও অশিল্পের ভেদরেখা মুছে দেয়। জ্যান্ডি নেলসনের লেখায়ও তার পরিচয় আছে।
বিপন্ন সময়ের আর্তনাদ যে নিঃসঙ্গ নিঃস্তব্ধতার ভেতর এভাবেই জারিত হয় তা একজন স্রষ্টা জানেন।তখন দুঃখের ঘরে দুঃখেরই ফসল ফলতে থাকে। লেখা হয় যে কবিতা তাকে অনেকেই কবিতা বলতে চান না। যখনই এই দুঃখ বা বিপদের সম্মুখীন হই, প্রাণ বাঁচানোর সংশয় জাগে—তখনই যে ভাষায় বাঁচাবার আবেদন জানাই তা-ই এক সরলীকরণ দুঃখের কবিতা। তাতে আর্তি ও আর্তনাদ যেমন থাকে, তেমনি হৃদয়ের ক্ষরণ এবং চোখের অশ্রুপাতও মিশে যায়। তখন খেয়াল থাকে না সেটি শিল্পসিদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছালো কিনা। যেমন ভালোবাসাকে অন্য শব্দে লিখতে পারি না, তেমনি কষ্টকেও অন্য শব্দে বলতে পারি না। সেরকমই কতকগুলি কবিতা লেখা হয়ে যায়—যেগুলিকে লেখার সময় মনে হয় না কবিতা লিখছি। আগুনে হাত পুড়লে যেমন তৎক্ষণাৎ হাত টেনে নিই, তেমনি কষ্ট ও শূন্যতা যখন চালিত করে—তখনও স্বয়ংক্রিয়ভাবে শব্দগুলি এসে যায়। কষ্টকল্পিত কোনো কবিতার কাছে পৌছাতে পারি না।
বর্তমানে সবচেয়ে কষ্টের হল—আমাদের মানুষ পরিচয় তথা মানব পরিচয় ক্ষুন্ন হয়েছে। নাম-ধর্ম-সম্প্রদায় চিহ্নিত করে গালাগালি করার এবং বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলে ও আচার-ব্যবহারে ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করে এক উগ্র অসহিষ্ণু রাজনীতিকরণের ঝোঁক দেখা দিয়েছে। মুশকিল হয়েছে যাদের অনুভূতি ক্ষমতা প্রখর ও তীক্ষ্ণ, যারা মানব মহিমার স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার প্রয়াসী, আঘাতটি তাদের কাছেই সবথেকে বেশি। তাদের হৃদয়তটেই সেই অভিঘাত বেশি আছড়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে আর বাঁচার রাস্তা নেই। মনে হচ্ছে এবার মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। মনে হচ্ছে ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছি। ভীষণ একা। চারিপাশে কেউ নেই। চারিপাশে শুধু জাত-ধর্মের বেড়া। চারিপাশে শুধু অস্ত্রের আমদানি। চারিপাশে শুধু উগ্র বোলচাল। হম্বিতম্বি। গর্জন। তখন তো লিখতেই হয়েছে:
“রাষ্ট্র যদিও অরণ্য, অহরহ গর্জন শুনি
কখনও শিকার হই, কখনও খেচর হয়ে উড়ি
বিপন্নতা আসে আর মুখোশ পরে হাসে
আতঙ্ক খুঁটে খুঁটে রোজ নিরিবিলি খোঁজ করি
কে আছ? চারিপাশে অন্ধকার
রক্তাক্ত হাতে ঘাতকের তলোয়ার
ধর্মের খাপে ঢাকা নির্দয় নিষ্ঠুর
আলো ধ্বংসকারী হত্যার ঘোষণা করে বারবার”
(অরণ্যরাষ্ট্র)
একটা রাষ্ট্রশক্তি যদি একটা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লাগাতার বিষোদ্গার করে চলে, তাহলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করার সামর্থ্য কি সামান্য কিছু জনগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব? হয়তো অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। হাতে এবং ভাতে মারতে মারতে বসতির ভিটেটুকুও উচ্ছেদ হয়ে যাবে। তাদের পক্ষে দাঁড়াবার মতো কেহই এগিয়ে আসবে না। সুতরাং মাথার উপরের আকাশ যেমন সরে যাবে, তেমনি পায়ের তলার মাটিও ধসে পড়বে। দাঁড়াবে কোথায়? এই ভাবনা থেকেই যখন ভাবনা আসে, তখন কবিতা শিল্পচর্চার বাতাবরণ থেকে আশ্রয়ের আর্তধ্বনিতে পদার্পণ করে। যে কজন শিক্ষিত মানুষ রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে—তাদের শেষ ঠিকানা হয় জেলখানা অথবা কবর। গণতন্ত্র যেমন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, তেমনি সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মগজধোলাইও হয়ে যায়। তারা রাষ্ট্রশক্তিকেই সমর্থন জানায়। যে রাষ্ট্র মানবিক রাষ্ট্র নয়, যে রাষ্ট্রের শাসক একটা বিশেষ ধর্মপথে অথবা বিকৃত ধর্মপথে দেশকে চালিত করতে চায়, সেই রাষ্ট্রে মানবিক চেতনার স্ফুরণ কতটুকু সম্ভব? সম্ভব নয় বললেই চলে। তাহলে পথ কই? সামনে শুধুই অন্ধকার। অন্ধকারে শিকার হয়ে অপেক্ষা করা। তখন যে লেখা লিখি তা হয়তো কবিতা নয়, কিন্তু সেই লেখার মধ্যে আর কোনো ছলনা থাকে না:
“বারবার আলো নিভে গেলে
পূর্বপুরুষের মুখ দেখতে চেয়েছি
আবার নতুন আলো জ্বেলে
বারবার দৈত্যরা এসে ভয় দেখিয়েছে
বারবার হিংসাকে তুলেছে বজ্র করে
ধর্মের প্রদীপে অধর্মের লেলিহান শিখা
এখনো জীবিত আমরা ঘোষিত সনদে
চিরদিন আছি ভারতীয়
মৃত্যুতেও তাই থেকে যাব
ইতিহাস, আমাদেরও নাম লিখে নিও!”
(স্বাধীনতা)
এই আকুতি দেশের জন্যই, বাঁচার জন্যই, আশ্রয়ের জন্যই। একে তো অন্য ভাষায় বলতে পারি না। তাই কবিতাতেও সরলীকরণ এসে উপস্থিত হয়।
শিল্প চর্চার জন্য যে স্থিরতা দরকার, নিজের মুখোমুখি হবার যে স্তব্ধতা কাঙ্ক্ষিত, যে স্বপ্ন দেখার পরিবেশ দরকার—সেসব কি এখানে আছে? যে দেশ বিদ্বেষ নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত করে, রাজধর্ম পালন করে না, সেই দেশ পরাধীনতার গ্লানি থেকেও এক ভিন্নতর গ্লানিতে ডুবে যেতে থাকে। ইতিহাস থেকে যেমন শিক্ষা নেয় না, তেমনি এর ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকেও বাঁচাতে পারে না। অত্যাচারী শাসক কখনো সসম্মানে যুগোত্তীর্ণ হতে পারে না। ক্ষমতা যাওয়ার পর জনগণ তাঁকে নিমেষেই ভুলে যায়। তাঁদের ছদ্মবেশ তখন পরিষ্কার হয়ে যায় জনগণের কাছে। সেই রাষ্ট্র ও শাসকের স্বরূপকে এভাবেই তো লিখতে হয়:
“রাষ্ট্র তবু একটা মাঠ, মাঠময় পাহাড়-পর্বত, অরণ্য-নদী-জলাশয়
সিংহের পোশাক পরা কোনো কোনো জন্তু
ময়ূরের কৃত্রিম শিখা লাগানো পাখি
মাঝে মাঝে শূন্যে উড়ে যাওয়া বাজ
ছলাকলা আর কৌশলগুলির ভেতর
আমরা ধোঁয়া উড়িয়ে দিই
অসহ্য দিনগুলি অস্বচ্ছ হয়ে ঘুরপাক খায়
ধর্ষকেরা মালা পরে নেমে আসে ঈশ্বরের নতুন শিবিকায়”
(সভ্যতা অন্ধকার)
রাষ্ট্রীয় মদতে যারা ধর্ষণ করে, দাঙ্গা করে, সারাদেশ অশান্তির আগুনে দগ্ধ করে—তাদের প্রতি শুধু ঘৃণাই জেগে ওঠে। কখনোই শ্রদ্ধা জাগে না। কবিতা সেই সময়কেই অনুবাদ করে। সেই যাপনকেই লিপিবদ্ধ করে। সেই ইতিহাসকেই শব্দে প্রতিধ্বনিত করে। কেননা সমকালকে একজন কবি কখনোই উপেক্ষা করতে পারেন না। কবিতা তাই সময়ের ডায়েরি। হৃদয়ের ডায়েরি। চেতনারও ডায়েরি। অনুভূতির প্রজ্ঞা থেকেই তার শব্দক্ষরণ। আত্মমন্থনের অভিঘাত থেকেই তার চিত্রলিপির নির্মাণ। একে কি অস্বীকার করা যায়?
“দিনের শেষেও বুঝি না কেমন দিন
পবনেও ওড়ে কত ছাই
রোদ্দুরেও রক্ত লেগে যায়
রক্ত লাগা ভবিষ্যৎও পাই।
বাজনা বাজে, কার বসন্ত?
অন্ধকারে হাতড়াই সেই হাত
রাত্রি রঙের ভ্রান্ত কোকিল ডাকে
রাষ্ট্র শুধু ধর্মে তেলেশমাত!”
(রাজনৈতিক)
নিজের অস্তিত্ব যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, নিজের আইডেন্টিটির যখন ক্রাইসিস দেখা দেয়, যখন বিশ্বাস হারিয়ে যায় দেশের ও দশের প্রতি, যখন রাষ্ট্রকে শত্রু মনে হয়, তখন বেঁচে থাকার স্বপ্ন-সাধ-আহ্লাদ কি আর সক্রিয় হয়ে ওঠে? এই অবস্থার মধ্যেই নিজের অবস্থান। আতঙ্কবাদের, ঘৃণাবাদের, সাম্প্রদায়িকতাবাদের এবং হিংসাবাদের ভেতর প্রতিনিয়ত ডুবে যেতে থাকি। যারা এসব দেখেন না, যারা এসব লেখেন না, তারা হয়তো আমাদের মতো এই কষ্টের মধ্যে পড়েন না। আমার কষ্ট, আমাদের কষ্ট; আমাদের মৃত্যু, আমার মৃত্যু শিল্পের কাছে না পৌঁছালেও তা যে লিখিত হয়, তার যে ছদ্মবেশ নেই, তার যে পোস্টমডার্ন রূপ নেই তা বলাই বাহুল্য।
🐦
চলবে…
তৈমুর খান