দুটি স্মরণীয় পত্রিকা
🐦
কলকাতা বইমেলা(২০২৩) উপলক্ষে প্রকাশিত দুটি লিটিল ম্যাগাজিন বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে খুবই স্মরণযোগ্য। প্রচ্ছদ থেকে লেখা নির্বাচন এবং বিষয় ভাবনায় এক ভিন্ন রুচির পরিচয় দান করেছে। আজকের আলোচ্য বিষয় এই দুটি ম্যাগাজিন নিয়েই।

১
আমাদের পদক্ষেপ
🍁
চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ‘আমাদের পদক্ষেপ’ বিষয় ‘উপেক্ষিত’-কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্তরের উপেক্ষিত ব্যক্তিত্ব,প্রতিষ্ঠান, ইতিহাস,নাটক, সংগীত, ছায়াছবি, অভিনেত্রী ও অভিনেতা, শিল্পী এবং কবি-লেখকদের তুলে আনার চেষ্টা করেছে। এ এক অনন্য ভাবনা। উপেক্ষিত বিষয়কে কেন্দ্র করে ইতিপূর্বে সারাবিশ্বে কেউ ভেবেছেন কিনা আমার জানা নেই, কিন্তু এই ক্ষুদ্র পত্রিকাটির আয়োজনে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। সম্পাদকীয়তে রবীন্দ্রনাথের একটা গানের লাইন উদ্ধৃতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সবার পিছে সবার নিচে সব হারাদের মাঝে’ এর আগের দুটি লাইনও আমি উল্লেখ করতে চাই ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন/সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে’ পত্রিকা সেই অধমদের কাছেই পৌঁছাতে চেয়েছে। মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন ‘কলকাতায় উপেক্ষিত উত্তরবঙ্গ, উত্তরবঙ্গে উপেক্ষিত হাংরি আন্দোলন’ এরকম ইতিহাসের পটভূমিকে তুলে আনা কি সহজ কথা? রামামৃত সিংহ মহাপাত্র বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের প্রত্নস্থল ‘পখন্না’-র উপেক্ষা নিয়ে লিখেছেন। খুবই তথ্যসমৃদ্ধ রচনা। লোকসাহিত্য থেকে প্রাচীন লিপি, জীবনযাত্রা, ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতি লোকসংস্কৃতির যাবতীয় দিক উন্মোচিত হয়েছে। উপেক্ষিত রামানুজকে নিয়ে লিখেছেন মৌ দাশগুপ্ত আদক। উপেক্ষিত মূকাভিনেতা নিরঞ্জন গোস্বামীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও এই সংখ্যার একটি মূল্যবান সংযোজন। সামাজিক প্রেক্ষাপটেও বেশ কয়েকটি লেখা রয়েছে যা খুব ভাবনার বিষয়। যেমন স্বপনকুমার ঠাকুরের ‘উপেক্ষিত লোকসম্পর্ক: হিন্দু-মুসলমান’, ড. রমলা মুখার্জির উপেক্ষিত ডাক্তার দিলীপ মহনালবীশ, কৌশিক বড়ালের উপেক্ষিত লোকনাট্য আলকাপ প্রভৃতি। ইতিহাসের আড়ালে থাকা বিপ্লবী, বৃহন্নলাদের জীবন, সিরাজের বেগম, সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত, কয়েকজন কবি এবং আরও বহু বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে। কবিতা ও গল্প লিখেছেন এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি-লেখকেরা। পত্রিকাটি অবশ্যই সংগ্রহযোগ্য। যোগাযোগ: নির্মলেন্দু কুণ্ডু, ২৪/১৫/১ জয়চাঁদ রোড, খাগড়া, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ-৭৪২১০৩, চলভাষ: ৮০১৬০৮৩০১৩, মূল্য ২০০ টাকা।

২
কবিতার আড্ডা
🍁
২৬ বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে আসছে ‘কবিতার আড্ডা’ পত্রিকাটি। এই সংখ্যায় প্রায় আশির অধিক লেখা রয়েছে। কবি শ্যামলকান্তি দাশ থেকে থেকে শুরু করে রাজীব মৌলিক পর্যন্ত কবির কবিতার দীর্ঘ সূচি। প্রতিটি লেখাকেই সুন্দরভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। বিশ্বজিৎ মাইতি লিখেছেন ‘ধরো, আজ এলোমেলো হাওয়া এসে ঢুকতেই পারছে না ঘরে—/ অবিমিশ্র স্তব্ধতাই ফুটে আছে ঘরের ভেতর’… মজার ব্যাপার হল এই স্তব্ধতা পত্রিকাটির লেখার মধ্যেই বিরাজ করছে। কিন্তু কবিতার শেষ লাইনটিতে আছে ‘জড়িয়ে আছে সোনালি রঙের এক সাপ।’ আর তখনই সুন্দরের সঙ্গেও এক জটিল আদিম চেতনার সম্মেলন দেখতে পাই। অভিনন্দন মুখোপাধ্যায় তখনই লিখতে পারেন ‘শিশু চাঁদ উঠে আসে রক্তহীন মায়ের সমাজে’। সুজিত ভৌমিকও লিখতে পারেন: ‘ফিকে হয়/কালো সাদা মেঘ/ ফিকে হয় আবছা আকাশ/তবু সত্য সন্ধানে’। এই সত্যসন্ধানের কাছে নিয়ে গেছেন কবি সুনীল মাজি এবং তপনকুমার মাইতি। একজন লিটিল ম্যাগাজিন আর লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের ইতিহাস ও ভূমিকা তুলে ধরেছেন। অন্যজন বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকার’ রহস্যময় জটিল আবর্তন। আমাদের অনুবর্তী করে তোলে তাঁদের লৈখিক ভাবনাও। অর্ণব পণ্ডার পাশে অনন্ত দাশের কবিতা শোভা পায় এই পত্রিকায়। তেমনি অজিত বাইরীর পাশে অরবিন্দ সরকারও। নরেশ দাসের পাশে সুপ্রভাত মেট্যাও। চন্দ্রভানু বিজলী, আনন্দমোহন দাস, কাবেরী মুখার্জিকেও সগৌরবে আমরা উপস্থিত হতে দেখি। প্রচ্ছদ ভাবনাটি ভীষণ ভালো লেগেছে এইজন্য কাব্যিক পালকে ধন্যবাদ। সব রকম যোগাযোগ: কৃতিসুন্দর পাল, আবাস বাড়ি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর-৭২১৬৩৬, চলভাষ:৮১১৬৮৪৯৪৬০, মূল্য: ১৫০ টাকা।
🐦
তৈমুর খান
পত্রিকা রিভিউ