Skip to content

Article

কবিগান সম্পর্কে কবিগুরুর নেতিবাচক ধারণা থাকলেও এর মধ্যে ধরা পড়েছিল বাংলার মাটি মাখা জীবনের সুর

বারিদ বরন গুপ্ত ৯ ফ্রেবুয়ারী ২০২৩ মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান:: বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য ধারা হলো কবিগান। এক সময় গ্রামবাংলাকে লোক শিক্ষা, নীতি শিক্ষার পাশাপাশি আনন্দ বিতরনের অঙ্গ হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই কবিগান, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে একসময় গ্রাম বাংলার প্রতিটি জনপদে কবি গানের আসর বসতো, বর্তমানে প্রাচীন লোক ও সংস্কৃতির এই ধরার চাহিদা অনেকটা কমলেও একেবারে হারিয়ে যায়নি। এখনো বিভিন্ন আসরে প্রাচীন প্রজন্ম তো বটেই আধুনিক প্রজন্মের সদস্যদেরও দেখা যাচ্ছে ! আজ পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের একটি গ্রামে সেই চিত্র লক্ষ্য করলাম ! পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের সাহাপুর গ্রামে কালী পূজা উপলক্ষে সুদীর্ঘকাল থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কবিগানের আসর বসে। বলতে গেলে সেই জমিদারি পর্ব থেকেই। এবছর তার ব্যতিক্রম হয়নি। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষজন পূজা উপলক্ষে নিত্যদিনের একঘেয়েমি কাজ থেকে ছুটি পেয়ে সেই ভোর থেকে কবিগানের আসরে জড়ো হয়েছে, বীরভূম এবং বর্ধমানের দুই স্বনামধন্য কবিয়ালের চাপান-উতোর এ আসর জমে উঠেছে। এবার এই আসরে কবি গানের বিষয়বস্তু সেকাল-একাল, দুই পুরুষের মতাদর্শগত লড়াই কে কেন্দ্র করে তুই বিদগ্ধ কবিয়ালের কাব্য লড়াই জমে উঠেছে, শ্রোতারা মোহাবিষ্ট হয়ে এই লড়াই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে।

মূলত কবিগান একটি প্রতিযোগিতামূলক গানের আসর। সাধারণত দুটি দলের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই গীত পরিবেশন করা হয়, দুইদলের প্রত্যেকটির একজন প্রধান গীতিকার থাকে, যাকে কবিয়াল বলা হয় এবং তাকে সহযোগিতা যারা করেন তাদের দোহারী বর্গ বলে। কবিয়াল এবং দোহারীদের চাপান উতরে আসর সরগম হয়ে ওঠে। কবিগন শুরু হয় মূলত স্তুতি বা বন্দনার মধ্য দিয়ে, সরস্বতী লক্ষী গণেশ ইত্যাদি বিভিন্ন দেবদেবী, তাছাড়া গুরু বা দর্শকদের উদ্দেশ্য এই স্তুতি পর্ব চলে, এরপরই শুরু হয় কবিগানের মূলপর্ব এই পর্বে নানান বিষয় থাকে, যেমন কর্ণ -অর্জুন, কুন্তি -কর্ণ, শাক্ত- বৈষ্ণব ,ধর্ম -অধর্ম, নারী-পুরুষ, একাল-সেকাল প্রভৃতি। এই অংশে প্রত্যেক কবিয়াল একে অপরকে গীতির মাধ্যমে আক্রমণ করে একগুচ্ছ প্রশ্ন রাখে, একে চাপান বলা হয়। বিপক্ষ দলের কবিয়াল এই প্রশ্নের উত্তর দেন যাকে উতোর বলা হয়। এই চাপান-উতোর এর মধ্য দিয়ে কবিগানের মূল সুর বেরিয়ে আসে, শ্রোতারা বিভিন্ন বিষয় জানতে বা বুঝতে পারে।

একসময় কবিগান প্রাচীন বাংলায় খুবই জনপ্রিয় ছিল। সাধারণত বিভিন্ন আখড়া, টপ্পা, খেউড়, তরজা প্রভৃতি গীতি ধারার মধ্য দিয়ে এর জন্ম বলে অনেকে মনে করেন। কবি গানের উদ্ভব অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বলে অনেকে মনে করেন ।এইসময় পর্বে কবিগান, পাঁচালী গান, ঝুমুর গান বাংলাদেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।সাধারণত কবিয়ালরা মুখে মুখে পদ রচনা করতেন এবং তারা বিভিন্ন আখড়ায় পরিবেশন করতেন। প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন জমিদারিতে গানের আসরে কবিগান পরিবেশিত হত। তৎকালীন গ্ৰাম সমাজের আনন্দ বিতরণের অঙ্গ হিসেবে কবিগান যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।

কবিগানের উদ্ভবের ইতিহাস নিয়ে বিজ্ঞ মহলে যথেষ্ট মতভেদ আছে। আমরা ঈশ্বর গুপ্ত, দীনেশ সেন, সুশীল কুমার দে , সুকুমার সেন ,অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকদের রচনাবলীতে কবি গানের উৎপত্তি ইতিহাস সম্পর্কে নানান তথ্য পাই। তবে সকল গবেষকই নিজে নিজে যুক্তির মাধ্যমে কবি গানের উৎপত্তি বিষয়টি নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। তাতে করে কবিগানের উৎপত্তির বিষয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
তবে একথা সত্য, কবি ঈশ্বর গুপ্ত তার ‘সংবাদ প্রভাকর” পত্রিকার কবিগান কে সর্বপ্রথম জনসমক্ষে নিয়ে আসেন।
তার তথ্য থেকে জানতে পারি গোঁজলা গুঁই নামক জনৈক ব্যক্তি এই কবি গানের উদ্ভাবক, তারপর তার শিষ্য লালু রঘুনাথ দাস এবং রামজী, কেষ্ট মুচি, প্রমুখেরা এই গানের হাল ধরেন, এবং এসব কবিয়ালদের হাত ধরে বাংলায় অসংখ্য কবিয়াল এর উদ্ভব হয়।এর পরবর্তীকালে যারা কবিগানকে গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় করে তোলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন ভোলা ময়রা এন্টনি কবিয়াল, রাম বসু, হরু ঠাকুর ,নিধুবাবু যিনি রামনিধি গুপ্ত নামে বহুল পরিচিত, এছাড়া বিজয় সরকার, রামানন্দ নন্দী ,রসিকলাল সরকার প্রমুখেরাও এই গানকে এক অতি উচ্চতায় তুলে ধরেন।

কবিগানের আদিরূপ প্রসঙ্গে ও বিজ্ঞ মহলে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে, ডক্টর সুকুমার সেন মনে করেন খেউড় হল কবি গানের আসল রূপ, আবার কেউ কেউ আখড়ায় সঙ্গীত বা ঝুমুর গান কে কবিগানের আদি রূপ বলে মনে করেন।আবার অনেকে মনে করেন প্রাচীন যাত্রা গান থেকেই নাকি কবি গানের উৎপত্তি। তবে বর্তমানকালের গবেষকগণ মনে করেন প্রাচীন লোক সমাজের প্রেক্ষাপটে থেকেই কবিগানের যাত্রাপথ শুরু যা প্রাচীন বাংলার সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় , তারপর এটি ধীরে ধীরে গ্রামীণ সমাজ থেকে শহুরে বাবু সমাজে সমাদৃত হয়। কবিগান সর্বপ্রথম কলকাতা বাবু সমাজে ঠাঁই পায়নি, উপনিবেশিক শাসনের সময় পড়বে সমাজ জীবনে একটা টানাপোড়েন চলতে থাকে, স্থিতিশীল সমাজের ভিত কিছুটা হলেও নড়ে ওঠে, পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ফলে সমাজের কিছু নিম্নশ্রেণির মানুষজন, ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরিসূত্রে, অর্থবান হয়ে ওঠে, এই শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ব্রিটিশদের হাত ধরেই, অনেকে মনে করেন এই নব বাবু সমাজের মাধ্যমেই শহরে কবিগানের প্রবেশ! অনেকে মনে করেন উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই কলকাতা শহরে কবিগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

অষ্টাদশ শতক থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত সময়কাল কবিয়ালদের যুগ বলে অনেকে অভিহিত করেন! আদি কবিয়াল গেঁজলা গুঁহ থেকে শুরু করে নন্দলাল, লালু ,ভোলা ময়রা, নিধুবাবু ,এন্টনি কবিয়াল প্রমুখদের হাত ধরে, কবি গান আপন ছন্দে এগুতে থাকে, উনবিংশ শতকে বর্ধমান এবং বীরভূম জেলায় কম করে তিনশত কবিয়াল ছিল বলে জানা যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নবাই ময়রা, সাহেব জান, চাঁদ মহম্মদ ,মধুসূদন ঘোষাল, সনৎ বিশ্বাস, দিলীপ চক্রবর্তী, সুবিমল ব্যানার্জি, হারাধন দে,কেনারাম মোদক, শিব শংকর পাল , জ্ঞানদাস প্রমূখ,।বিংশ শতকে আমরা বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় কবিয়াল এর কথা জানতে পারি তাদের মধ্যে অন্যতম হলো হরিচরণ আচার্য ,রমেশ শীল, রাজেন সরকার, তারক নাথ সরকার প্রমূখ। এসব কবিয়ালের মাধ্যমে কবিগানে আধুনিকতার ছোঁয়া আসে, এরা কবি গানের মাধ্যমে সৃজনশীল ও কাব্য প্রতিভার সমন্বয় সাধন করেন।

কবিগুরু কবিগান কে ‘নতুন সামগ্রী, নষ্ট পরমায়ু’ বলে অভিহিত করেন! এই অভিযোগ পুরোপুরি সত্য বলে মনে হয় না! কবিগান গ্রামীণ সমাজ সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট থেকে উঠে এসেছে। একটা কথা অস্বীকার করলে চলবে না বেশিরভাগ কবিয়াল-ই উঠে এসেছেন সেই গ্রামীণ সংস্কৃতির মাটি মাখা জীবন থেকে, তাই প্রাথমিক পর্বে ঝুমুর, খেউর, আখড়াই গানের প্রভাব থাকবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না, তাই হয়তো প্রথম পর্বে কবিদের পদ বা কবিতায় খুব একটা রুচির চিহ্ন ছিল না, একে অপরকে আক্রমণ করে ক্ষণিক আনন্দ দানই ছিল কবিগানের মূল উদ্দেশ্য! তাই আমরা দেখি অষ্টাদশ শতকের একেবারে শেষ এবং অনুবিংশ শতকের শুরুর থেকেই গ্রামীণ সমাজ সংস্কৃতি প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা বাবু শ্রেনীর (জমিদার) মনোরঞ্জনের জন্য কবিয়ালরা বিভিন্ন জমিদারি সেরেস্তায় তাৎক্ষণিক পদ সৃষ্টি করে হয়তো নিম্ন রুচির চটুল সংগীত পরিবেশন করতো, এক্ষেত্রে মনোরঞ্জনের বিষয়টাই ছিল মুখ্য! কিন্তু পরবর্তীকাল ব্রিটিশ শিল্প বাণিজ্য নীতি কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ,পাশ্চাত্যীকরণ, ইত্যাদির প্রভাবে জামিন সমাজ সংস্কৃতি পরিবর্তন ঘটেছে, গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছে, বিভিন্ন সমাজ সংস্কার মূলক আন্দোলন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটেছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে কবিগানের ধারার পরিবর্তন ঘটেছে, ধীরে ধীরে পরবর্তীকালে কবিগানের ধারার বিবর্তন ঘটেছে, সমাজের সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়া, দ্বন্দ্ব, ইত্যাদি বিষয়গুলো ঠাঁই পেতে থাকে, স্বাধীনতা পর্বে কবিগান দেশপ্রেম জাগ্রত করতে সাহায্য করেছিল, সেই অর্থে মুকুন্দদাস কেও আমরা একজন কবিয়াল বলতে পারি। কবিগান নিয়ে কবিগুরুর নেতিবাচক মনোভাব থাকলেও একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা কবিগান প্রাচীন বাংলায় শিক্ষা- সংস্কৃতি বিকাশে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। কবিগান প্রাচীন বাংলার হারানো সাহিত্যের এক রূপ এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই। এই গানের মাধ্যমে প্রাচীন গ্রাম সমাজের অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনের ছবি ফুটে উঠে। তাছাড়া মানুষের সুখ দুখ, দ্বন্দ্ব ভালোবাসা,চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো যথেষ্ট পরিস্ফুটিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, শিক্ষার আলো থেকে পিছিয়ে পড়া নিরক্ষর মানুষজন এই কবি গানের মাধ্যমে শিক্ষার আলো পেয়েছিল । কবিয়ালরা তাদের ভাব এবং আধ্যাত্মিকতা জ্ঞানের স্বর্ণ ভান্ডার থেকে গ্রাম বাংলার পিছিয়ে পড়া মানুষ জন কে অকাতরে স্বর্ণরেণু সম জ্ঞান দান করেছে, নিরক্ষর অর্ধ শিক্ষিত মানুষের চিন্তা চেতনার জগতে বিকাশ ঘটিয়েছিল এই কবিগান। তাছাড়াও পরাধীন ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিল এই কবিগান।পরিশেষে আমরা বলতে পারি প্রাচীন বাংলার স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের সংস্কৃতি রক্ষক হিসেবে, লোক শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি করতে কবিগান এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল একথা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই।

আজকে এই কবিগানের অসর থেকে প্রাচীন বাংলার প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা এই গানের উপযোগিতা কে অস্বীকার করার জায়গা খুঁজে পাইনি, অনেক কিছু বিষয় গীতির মাধ্যমে জানা গেল, বর্তমান প্রযুক্তির ধাক্কায় এই প্রাচীন সংস্কৃতির অনেকটাই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, ভবিষ্যতে আরো কতটা আঘাত করবে তা হয়তো এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না, আসুন সকলে বলি-” বেঁচে থাক প্রাচীন লোক সঙ্গীত কবিগান আর”কবিগানের মাধ্যমে ভেসে আসুক প্রাচীন লোক সমাজের সুর।”

*লেখক প্রাচীন লোক সমাজ ও সংস্কৃতির গবেষণামূলক প্রবন্ধ,ও ফিচার লেখার সাথে যুক্ত।

Barid Baran Gupta

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *