গরিব মানুষ মহান
বারিদ বরন গুপ্ত
আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে গ্রাম বাংলার আর্থিক কাঠামো খুবই খারাপ ছিল! তখন সবুজ বিপ্লবের প্রভাব পশ্চিমবাংলায় খুব একটা পড়েনি, চাষবাস ছিল অনেকটা সেই সাবেকি ধরনের, বছরে একবারই ধান চাষ হতো, তাও ফলন খুব কম হতো, চাষবাসে রাসায়নিক সারের প্রচলন খুব একটা ছিল না, চাষিরা জৈব সারের ওপরই বেশি ভরসা করতো, পুকুরের পাক, গোবর, বাড়ির আবর্জনা, ইত্যাদি দিয়েই সারের অভাব পূরণ করতো, রাসায়নিক সার বলতে আমোনিয়া, ফসফেট ,পটাশ ইত্যাদি অনেকেই ব্যবহার করতো, তবে একটা কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে সেই সময় আষাঢ়- শ্রাবণ মাসে অনেক চাষীর চাষ করার মত আর্থিক সামর্থ ও থাকতো না, এক কথায় তখন গ্রাম বাংলার চাষবাস অনেকটাই রুগ্ন প্রকৃতির ছিল, সেটা অবশ্যই আর্থিক সঙ্গতির নিরিখে! গ্রামের দু একজন জোতদার চাষী ছাড়া সকলেই এই পর্যায়ের! আর গ্রামে খেটে খাওয়া জনমজুর শ্রেণীর মানুষদের অর্থনৈতিক কাঠমো কি অবস্থায় ছিল তা সহজেই অনুমেয়! বছরে দুবার কাজ জুটতো, একবার আষাঢ় শ্রাবণ ধান রোপনের সময়, আর অঘ্রান পৌষ মাসে ক্ষেত থেকে ধান তোলার সময়। বাদবাকি সারা বছর প্রায় কর্মহীন জীবন যাপন করতে হতো, ধার দেনা করে ঋণে ভারাক্রান্ত হয়ে অসহায় ভাবে জীবন যাপন ছিল নিত্য সঙ্গী।
তখনো গ্রাম বাংলার স্বয়ংসম্পূর্ণতার শেষ চিহ্ন মুছে যায়নি, যজমানি ব্যবস্থা ও অনেকটাই অটুট ছিল! গ্রাম বাংলা থেকে রীতিনীতি আদর্শ মূল্যবোধ তখন হারিয়ে যায়নি, মানুষজন সমর্থ্য অনুযায়ী দান-ধ্যান করতো, অনাথ আর্তের সেবার মানসিকতা যথেষ্ট জাগ্রত ছিল! স্বাভাবিকভাবে সেই সময় গ্রাম বাংলার দুয়ারে দুয়ারে প্রচুর ভিখারী দেখা যেত। অনেকেই দেখতাম ভিখিরির ভয়ে দুপুরবেলায় বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিত!
সেই সময় পর্বে, বর্ধমান জেলার পশ্চিম দক্ষিণের অঞ্চলগুলোতে আর্থিক অবস্থা ভালো থাকলেও, পূব বা উত্তর নিম্নভূমি এলাকায় বন্যা জনিত পরিস্থিতির জন্য আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট সঙ্গীন ছিল, মানুষজন এটা, ওটা, আধপেটা, সিকি পেটা খেয়ে জীবনটাকে অতিবাহিত করেছে।
সাতের দশকের শেষ পর্বের কথা, আমি তখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি, সেই সময়ে পূর্বস্থলীর কোড়াপুর বেলগড়ে থেকে একজন ভিখারি আমাদের গ্ৰামে আসতো, এক সময় জমি জায়গা ভালোই ছিল, যেভাবেই হোক দেনার দায় সব চলে গেছে, তাই ভিখারি বিত্তি করে পরিবারের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিচ্ছে, ভিখারিদেরও একটা রুটিন থাকে, এক এক সপ্তাহে এক এক অঞ্চলে তারা হাজির হয়, ওই ভিখারি ভদ্র লোক প্রতি মঙ্গলবার আমাদের গ্রামে আসতো আর ভিক্ষার শেষে গ্রামের দুর্গা মন্ডপে এসে তার ক্লান্তি দূর করতো, আমরাও দুপুর বেলায় দুর্গা মন্ডপে এসে খেলাধুলা করতাম, মাঝে মাঝে জল এনে ওনার তৃষ্ণা মেটাতাম, বিনিময়ে আশীর্বাদ তো পেতামই তার সাথে সাথে উনি আমাদের অনেক গল্প শোনাতেন! তবে বেশিরভাগটাই দুঃখের গল্প জীবনের গল্প, সংগ্রামের গল্প, সমাজের মানুষের গল্প, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের আচার-আচরণ মনোবৃত্তির এক দলিল আমাদের সামনে তুলে ধরতেন! উনিই একদিন আমায় শুনেছিলেন-‘ গরিব মানুষ মহান!’
উনি একদিন বললেন যে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরি আমি কিন্তু গরিবের দরজা থেকে ফিরে আসি না তারা তাদের ভাগ থেকে আমাকে সামান্য হলেও সাহায্য দেয়, কিন্তু গ্রামের অনেক আর্থিক সম্পন্ন গৃহস্থ মানুষ আমাদের দেখলে দরজা বন্ধ করে দেয়। এই যে আজ তোমাদের গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে যেখানে দিন-দরিদ্র জন মজুরদের বাস কোন বাড়ি থেকে ফিরিনি, কিন্তু এই অবস্থাপন্ন সম্ভ্রান্ত পাড়ায় অনেক বাড়ি থেকে ফিরতে হয়েছে, হয়তো দরজা বন্ধ না হয়তো-‘ মাফ করে দাও!’ তখন হয়তো অপরিণত বুদ্ধিতে ‘গরিব মানুষ মহান’ এই কথাটার সঠিক অর্থ বুঝতে পারিনি! কিন্তু আজকে আমি ক্ষেত্র গবেষণার সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে এসে তার সেই অর্থটার সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছি!
কয়েক মাস আগে ক্ষেত্র গবেষণায় গিয়েছিলাম পূর্বস্থলী ২ নম্বর ব্লকের এক প্রাচীন বর্ধিষ্ণু গ্রামে, এক প্রাচীন মন্দির এবং দেব দেবীর ইতিহাসের অন্বেষণে, যাই হোক গানের এক বয়স্ক ব্যক্তি পূজারী ব্রাহ্মণের বাড়ির সন্ধান দিল, রাঢ়ীয় ভরদ্বাজ গোত্রীয় মুখার্জি বংশোদ্ভুত, একসময় পাণ্ডিত্যের জন্য এই অঞ্চলে যথেষ্ট কদর ছিল, বাড়িতে একটা প্রাচীন শিব মন্দির ও রয়েছে! মন্দিরের মধ্যে অন্ততপক্ষে গোটা কুড়ি নারায়ণ শিলা, বিংশ শতকের প্রথম জানতে পারলাম অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার এই গ্রাম থেকে চলে গেছে তারা তাদের কুলো দেবতাকে এই মন্দিরে পুরোহিতের কাছে জিম্মাদার হিসেবে রেখে গেছে! এক সময় আর্থিক অবস্থাতে যথেষ্ট ভাল ছিল তা বাড়ির কাঠামো দেখেই বোঝা যায়, কিন্তু বর্তমানে দৌনতার চিহ্ন নোনা ইট খসে পড়া চুন সুরকির স্তুপ জানান দিচ্ছে, যাই হোক মুখার্জি মশাই পূজা পাঠ সেরে আমায় মন্দিরের দরদালানে নিয়ে গিয়ে বসালেন, প্রথমে প্রসাদ, মুখে পড়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে নিলাম! তারপরে এলো চা! চা খেতে খেতে বিভিন্ন গল্প, গল্পের যেন শেষ হয় না, আমি হা করে তাকিয়ে এক মনে ডাইরির পাতা ভরে নিচ্ছি, কখন যে ঘড়ির কাটা দুটোর ঘর ছুঁয়েছে খেয়াল করিনি! মাঝে মাঝে বাড়ির দু এক জন উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, বুঝতেই পারছি মুখার্জি মশাকে খাওয়ার জন্য হয়তো তাগাদা দিচ্ছে! কিন্তু ওনার গল্প যেন শেষ হচ্ছে না, অবশেষে আমি বললাম তাহলে আজকে উঠি! অনেক বেলা হয়ে গেছে, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম! কষ্ট কেন, এটা তোমাদের কর্তব্য ! আমাদের ঠাকুরের ইতিহাস সকলে জানবে, এটা কি কম পাওনা! আমি বললাম- অবশ্যই !
আমি খাতা পত্র ডায়েরি গুছিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি! মুখার্জি মশাই আমার হাত ধরে বললেন-‘ঘড়িতে কটা বাজে খেয়াল আছে! এতদূর থেকে এসেছেন আর এই দুপুরে আমি আপনাকে ছেড়ে দেবো! যৎ সামান্য যা হয়েছে দুটি খেয়ে যান! আমি বললাম-‘ আপনি বললেন এটাই যথেষ্ট! আমি অন্য একদিন এসে খেয়ে যাব! উনি বললেন -‘যেদিন আসবেন সেদিন ও খাবেন, কিন্তু এই ভরদুপুরে আপনাকে ছাড়তে পারি না, কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারলাম না, বসতেই হল আহারে!
খেতে খেতে মনে পড়ে গেল সেই ভদ্রলোকের কথা-‘গরিব মানুষ মহান!’ বেঁচে থাকো তোমরা আর তোমাদের মহত্ব, মানসিকতা যা বর্তমান সমাজে যে বড়ই দুর্লভ! ে
Barid Baran Gupta