ভ্রমণ
দু’দিনের ভ্রমণকথা
শংকর ব্রহ্ম
——————————————————-
দীর্ঘ আট মাস গৃহবন্দী থাকার পর, আর ঘরে মন টিকছিল না। হঠাৎ করেই, সাতাশে নভেম্বর দু’হাজার কুড়িতে দু’দিনের জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। তার দু’দিন আগে থেকেই তোড়জোর শুরু হলো বেরবার উদ্দেশ্যে। জামা কাপড় গুছানো সঙ্গে কি কি নিতে হবে, তার ব্যস্ততায় কেটে গেল কোথা দিয়ে দুটো দিন, প্রাক্ প্রস্তুতি হিসাবে।
তারপর ড্রাইভারের সাথে কথা বলা ছিল, সকাল ছটায় গাড়ী আসবে। রাতে ভাল করে ঘুম হল না। সকালে উঠে বেরবার জন্য স্নান করে বাথরুম সেরে, চা টিফিন খেয়ে নিলাম। ঠিক ছটায় বাড়ির সামনে গাড়ি এসে হাজির। উঠে পড়লাম তাতে। মুক্তির আনন্দ মনের ভিতর ডানা মেলে দিল।
গাড়ি চলতে শুরু করল। প্রকৃতির কী মনোরম দৃশ্য, ঘর থেকে না বের হলে তা বুঝতাম না। দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন চোখটা লেগে এসেছিল, রাতে ভাল করে ঘুম হয়নি তাই।
কলকাতা ছেড়ে হাওড়ায় ঢুকতে বিদ্যাসাগর সেতুতে টোল ট্যাক্স নিল দশটাকা। তারপরই ঘুমটা এসেছিল সুমধুর বাতাসের আলিঙ্গনে দু’চোখ জুড়ে আমার।
গাড়ি খড়গপুরে পড়তে, অশোক ধানুকানি-খড়গপুর টোল পাজা চোখে পড়ল।সেখানে টোল ট্যাক্স নিল একশ পাঁচ টাকা। সোনাপেটিয়া( তমলুক- মিলন নগর) বলে আর এক জায়গায় নিল আশি টাকা টোল ট্যাক্স। এই ভাবে টাকা বিলোতে বিলোতে গাড়ি তো এগিয়ে চলল সামনের দিকে। আমিও চারিদিকে তাকিয়ে
অফুরন্ত দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে চলেছি। দেখতে দেখতে চোখও এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। চোখ বুঝে রইলাম কিছুক্ষণ নিশ্চিন্তে। কখন তন্দ্রায় আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম,
টের পাইনি। তন্দ্রা ভাঙল হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয় পড়ায়।
তারপর ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চলল দ্রুত গতিতে, জ্যামে পড়লেই গাড়ির গতি শ্লথ হয়ে এলো। এই ভাবে
এগোতে এগোতে সাড়ে এগারোটায় এসে পৌঁছালাম, মন্দারমণি। রাস্তার দুপাশে বিশাল বিশাল ভেড়ি, কোথাও বা একদিকে ভেরি অন্যদিকে ধান ক্ষেত। বেশির ভাগ ক্ষেতেরই ধান কাটা হয়ে গেছে। কোথাও কাটা ধান মাঠে
পড়ে আছে, তোলা হয়নি গোলায়। এই সব দেখতে দেখতে ভিড় কাটিয়ে জ্যাম এড়িয়ে মন্দারমণি পৌঁছাতে বেলা সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
কোন ঘর আগে থেকে বুকিং করা ছিল না। কয়েকটা রিসর্ট খোঁজ করে দেখার পর, ‘সান রাইজ’ নামে একটা রিসর্ট পছন্দ হলো, সেখানে উঠলাম মনের আনন্দে। তারপর সেখানে খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোলাম সমুদ্র দেখতে। তখন ভাটার টান, জল সরে গেছে অনেকটা দূরে। বিচ ধরে অনেকটা পথ হেঁটে সমুদ্রকে ছুঁয়ে এলাম। তারপর ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম নেমে এলো চোখ জুড়ে।
সন্ধ্যায় ঘুম ভেঙে উঠে দেখি শো শো সমুদ্র গর্জন। কাছে গিয়ে দেখি, সমুদ্র এগিয়ে এসেছে
রিসর্টের সিঁড়ি পর্যন্ত। এখন জোয়ারের সময়। সামনেই পূর্ণিমা বলে আকাশের প্রায় পূর্ণ বিকশিত চাঁদের আলো, ঢেউগুলোর পরে রূপালী রেখার ঝিকিমিকি।
সে দৃশ্য শুধু অনুভব করা যায়, বর্ণনা করা দুরূহ। কিভাবে তার রূপ-বিভার বর্ণনা করব? মোহময় এক
আকর্ষণে চোখের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানো অসম্ভব। একবার চাঁদ দেখি, আকাশের বুকে নক্ষত্রদের মিটিমিটি হাসি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সমুদ্রের গর্জন শুনে দৃষ্টি আবার নেমে আসে সমুদ্রের বুকে, তার তীব্র শো শো গর্জন অজান্তে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেদিকে। মুগ্ধ বিস্ময়ে, বিমূঢ় ভাবে দু’ঘন্টা যেন মুহূর্তে কেটে যায় কিভাবে। বুকের ভিতর সমুদ্র তার রূপবৈভব নিয়ে ঢুকে পড়ে। রাতে এসে ঘুমের ভিতরও সে তার স্বপ্নের রাজ্য বিস্তার করে মুগ্ধ করে রাখে।
বাস্তবে যা করতে পারিনি স্বপ্নে তা দেখে ফেলি। স্বপ্নের ভিতর সাতার কাটতে কাটতে মাঝ সমুদ্রে চলে যাই। সেখানে ঢেউ ততো উত্তাল নয়। কত রকম সামুদ্রিক প্রাণী আমাকে দেখতে ছুটে কাছে চলে আসে। স্থলভূমির প্রাণীকে ওরা যেন বিমূঢ় বিস্ময়ে দেখে অভিভূত হয়ে। তাদের মধ্যে অতি উৎসাহী কেউ কেউ গা ছুঁয়েও দেখে যায় ভাল করে । জলে ডাঙার উপদ্রপ ভেবে সব শেষে একটা তিমি মাছ নাক দিয়ে জলের ফোয়ারা ছিটাতে ছিটাতে গিলতে চলে আসে আমাকে। ভয়ে ঘুমটা ভেঙে যায়। মনে মনে ভাবি, ভাগ্যিস স্বপ্ন ছিল এটা। না হলে এতক্ষণে আমি তিমির পেটে চলে যেতাম। তারপর কি হতে, কে জানে?
প্রথমদিনটা এভাবেই মন্দারমণিতে কেটে
গেলে। পরের দিন বের হলাম চা পান সেরে বেলা দশটার মধ্যে তাজপুরের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁচ্ছে সমুদ্রের সঙ্গে দেখা হল না। কারণ সে তখন অনেক দূরে সরে গেছে ভাটার টানে। অনেকগুলি পাথের স্ট্যাচু দেখলাম,
সবই সামুদ্রিক প্রাণীর – কোনটা কাঁকড়া, কোনটা মাছ, কোনটা বক এই সব নানা রকমের স্ট্যাচু দেখে মুগ্ধ হলাম। ওখানে খু্ব ডাব বিক্রি হয়, সকলেই খাচ্ছে দেখে আমিও খেলাম দুটো, দাম মাত্র ত্রিশ টাকা করে প্রতিটি।
ওখান থেকে বের হলাম বেলা বারটায়, দীঘার উদ্দেশে। চাউল খোলা জায়গাটা জংশন। যেখানেই যাও, চাউল খোলা হয়ে যেতে হবে। আমাদের গাড়িও চাউল খোলা ফিরে এলো। তারপর গাড়ি ঘুরলো দীঘার দিকে। বিশ্ব বাংলার তৈরী দীঘার তোরণগেট পেরিয়ে গাড়ি চলল দীঘার দিকে। খিদেও পাচ্ছে খুব টের পেলাম। দীঘায় নেমে একটা হোটেলে ঢুকে পেট পুরে ভাত, ডাল, আলুভাজা, ফুল কপির তরকারি, মাছের-কারি, দই খেলাম তৃপ্তি করে। দাম মিটিয়ে দিয়ে দীঘার পাড়ে গিয়ে বসলাম। শরীর জুড়িয়ে এলো সামুদ্রিক উদ্দাম বাতাসে।
সমুদ্র গর্জন করে এগোচ্ছে সামনের দিকে জোয়ারের টানে। কী মোহময় তার আকর্ষণ। কোন ভাবেই উপেক্ষা করার উপায় নেই। মন্দারমণির থেকে এখানে সমুদ্রের উচ্ছাস অনেক বেশী। তাই যেন তার আকর্ষণও বেশী।
অনেকক্ষণ সেখানে কেটে গেল। আমি আবার যাব দীঘার মোহনা দেখতে। তাই বাধ্য হয়ে সেখান থেকে উঠে পড়তে হলো। একশোগ্রাম কাজু বাদাম কিনে নিলাম একশ টাকা দিয়ে। গাড়িতে উঠে কাজু বাদাম খেতে খেতে চললাম মোহনার উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌচ্ছাতে ছটা বেজে গেল।
এটা আন্তর্জাতিক মাছের বাজার। মাছের আসটে গন্ধে পরিবেশ মাতোয়ারা। গা গুলিয়ে উঠল। তবুও এগোলাম গাড়ি নিয়ে। গিয়ে পৌঁছালাম সেখানে। চম্পা নামক নদী মিলেছে সমুদ্রের সঙ্গে। দুটি জলধারা দু’রকম। রঙও ভিন্ন, জলের স্বাদও ভিন্ন। নদীর জলের স্বাদ মিষ্টি, আর সমুদ্রের জলের স্বাদ নোনা।
আর একটা থেকে আর একটা আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে, স্পষ্ট দু’টি জল ধারার গতি। সেখানে এককেজি ইলিশ মাছের দর করলাম। দাম কম নয় মোটেও। কলকাতার মতোই দাম। বারশো টাকা করে চাইল। হাজার টাকা করে দেবে বলল। এখানেও দরদাম করে হাজার টাকা করে কেনা যায়।
সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে, চম্পা নদীর ধারে, একটা চায়ের দোকানে বসে চা খেয়ে গাড়ি নিয়ে, আবার চাউল খোলা হয়ে মন্দারমণির ‘সান রাইজ’ রিসর্টে ফিরে এলাম রাত ন’টায়। রিসর্টে দাম বেশী জেনেও সেখানে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম, রুটি আর মুরগীর কষা মাংস। তৃপ্তি করে খেলাম সবকিছু চেটে-পুটে।
খাওয়া দাওয়া সেরে রিসর্টের সিঁড়ি দিয়ে নেমে সমুদ্র পাড়ে বসে কিছুটা সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের পরিশ্রমে এত ক্লান্ত ছিলাম, কখন ঘুমিয়ে পড়লাম টের পাইনি। এক ঘুমে ভোর হয়ে গেল।
ভোরে উঠে গায়ে চাদর জড়িয়ে, রিসর্ট থেকে বেরিয়েই দেখলাম উল্টো দিকে খেজুরের রস বিক্রি হচ্ছে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। সেখানে দশটাকা করে দু গ্লাস টাটকা রস পান করে মনটা ভরে গেল। শহরে এ রসের স্বাদ কখনও পাওয়া যাবে না। সেখানে গুর জ্বাল দেওয়া হচ্ছে দেখে,একশটাকা কেজি দরে এক কেজি নলেন পাতলা গুর, আর একশ চল্লিশ টাকা কেজি দরে এক কেজি নলেন পাটালি গুর কিনে নিলাম।
মন্দারমনির সমুদ্র তীরবর্তী সৈকত অঞ্চলে,
বা তার আশেপাশে থেকে কিছুটা দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু খেজুর গাছের সারি। এই গাছগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে গুড় তৈরির ব্যবস্থা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই খেজুর বনের আসে পাশে বা অনতিদূরে গুড় তৈরির কারিগররা অস্থায়ী বসতি গড়ে, বসবাস করে। খেজুর গাছগুলো লীজে নেওয়া হয় । কারিগরদের অস্থায়ী বসতি তৈরি হয় বাঁশ, বেড়া ও শুকনো খেজুর পাতা দিয়ে। মূলতঃ কারিগরদের অনেকেরই স্থায়ী বাড়ি কাঁথি এবং নন্দ কুমার।
এবারে আসি গুড় তৈরির প্রক্রিয়ায়। খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরি করার পদ্ধতি সহজ হলেও তা বেশ পরিশ্রম সাপেক্ষ ও কষ্টকর কাজ। সন্ধ্যায় বা রাতে খেজুর গাছের মাথায় চড়ে পাত্র বেঁধে দিয়ে আসতে হয়, এবং আগের দিনের বাঁধা রস সমেত পাত্রটি খুব ভোরে উঠে নামিয়ে আনতে হয়। পাত্র হিসেবে আগে মাটির হাঁড়ি বা ঘট ব্যবহার হলেও এখন প্লাস্টিকের বোতল, কৌটো বা ড্রাম জাতীয় পাত্র ব্যবহৃত হয়। আগের দিনের বাঁধা রস সমেত পাত্রটি নামিয়ে এনে সেটার বেশিরভাগটাই গুড় তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। গুড় তৈরির জন্য সেই খেজুর রস একটি বিশাল আয়তকার পাত্রে (দেখে যতদূর মনে হয় পাত্রটি টিন বা অ্যালুমনিয়ামের তৈরি) ঢালা হয়। তারপর সেই পাত্র মাটির তৈরি উনুনের উপর কাঠের তীব্র জ্বালে বসিয়ে ফোটাতে হয়। মাঝে মাঝে শুকনো গোছা বাঁধা পাটকাঠি দিয়ে নেড়ে দিতে হয়। কাঠের জ্বালে সেই খেজুর রস ফুটতে ফুটতে আস্তে আস্তে গুড়ে পরিণত হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটা হতে সময় লাগে প্রায় ৬-৮ ঘণ্টা। কারিগররা সকালবেলা ছ’টা নাগাদ এই খেজুর রসের জ্বাল বসায় এবং তা গুড়ে পরিণত হতে প্রায় বেলা ১-২ টো বেজে যায়। তারপর সেই গুড় উনুন থেকে নামিয়ে বেতের চাটাই দিয়ে ঢেকে রাখা হয় ঠাণ্ডা করার জন্য। বিকেলবেলা টাটকা জমাট বাঁধা গুড় পাওয়া যায়। একটা আয়তকার পাত্র থেকে ২৫ থেকে ৩০ কেজি গুড় পাওয়া যায়।
খেজুর রসের বেশিরভাগটাই গুড় তৈরির কাজে ব্যবহৃত হলেও কিছুটা রস সকালের পানীয় হিসবেও ব্যবহৃত হয়। স্বচ্ছ খেজুর রস খালি পেটে খেলে নাকি খুব উপকার পাওয়া যায়। পেটের সমস্যা কেটে যায়, হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়। তবে সেই রস পান করতে হবে সকাল সকাল-ই। যত সকাল সকাল খেজুরের রস খালি পেটে খাওয়া যাবে, ততো উপকার। তবে যত বেলা বাড়বে, স্বচ্ছ খেজুর রস ততো ঘোলা হতে হতে হেজে যাবে। তখন তা নেশার পানীয়তে পরিণত হয়।
আজ এগারোটায় ঘর ছেড়ে দিতে হবে। তার আগেই সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নিলাম। বাথরুম সেরে
স্নান করে নিলাম। রিসর্টেই চা খেলাম দু’কাপ। পনেরো টাকা করে এককাপ চায়ের দাম নিলো। ট্যুরিষ্ট প্লেস বলেই বোধহয় , এখানে সব কিছুরই দাম বেশ বেশী খেয়াল করে দেখলাম। রিসর্টের ভাড়া ছিল পার ডে দেড় হাজার টাকা করে। রিসর্টে এডভান্স কিছু দেওয়া ছিল, বাকী টাকা মিটিয়ে রিসর্ট ছেড়ে দিলাম। এবার বাড়ি ফেরার পালা।
দুপুরে কোলাঘাটে গাড়ি থামিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ সারলাম। তারপর গাড়ি আবার দ্রুত বেগে চলতে শুরু করল কলকাতার উদ্দেশ্যে নিরিবিচ্ছিন গতিতে। মাঝে মাঝে চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। তবু যতটা সম্ভব জেগে থাকার চেষ্টা করলাম। চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে ঘুমে ঢুলেও পড়ছি। আবার জেগে উঠে দেখছি যতটা সম্ভব হয়।
এই দু’দিন জীবনের অমূল্য সঞ্চয় হয়ে রইল।পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্পটে তোলা ছবিগুলো দেখব, আর স্মৃতিচারণ করে মনে অপার আনন্দ লাভ করব। সেটাই বোধহয় এ ভ্রমণের স্বার্থকতা। তাই নয় কি,আপনারা কি বলেন?
শংকর ব্রহ্ম